শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে প্রযুক্তির গেমসে আসক্ত শিক্ষার্থীরা
প্রতিনিধি, ঠাকুরগাঁওঃ
করোনা মহামারীতে দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। একরকম গৃহবন্দি হয়ে আছে শিক্ষার্থীরা। থেমে গেছে অনেক শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক জীবন। বিশেষ করে স্কুল পর্যায়ে ক্লাস ও পরীক্ষাসহ পড়ালেখার খুব একটা চাপ না থাকায় দিনের বেশির ভাগ সময়ই মোবাইল বা কম্পিউটারে গেম খেলে সময় পার করছে শিক্ষার্থীরা। কিশোরদের পাশাপাশি এই তালিকায় আছে প্রাথমিকের কোমলমতি শিশুও। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন। বিরূপ প্রভাব ফেলছে শিশু-কিশোরদের মানসিক ও শারীরিক আচরণে।
গত বছরের ১৭ই মার্চ থেকে বন্ধ কোচিং সেন্টারসহ প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরপর ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা ছাড়াই প্রথবারের মতো অটো পাস দেয়া হয়। এর আগে প্রাথমিকের সমাপনী পরীক্ষা ছাড়াই পরবর্তী ক্লাসে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমতি দেয় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা গ্রহণ ছাড়াই অটো পাসের কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। কাজেই শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার খুব একটা চাপ নেই। ফলে গেম খেলাকেই তারা সঙ্গী বানিয়ে ফেলেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঠাকুরগাঁওয়ে ৯১টি মহাবিদ্যালয়, ২৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৩৯টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৬৯টি মাদরাসা ও ৯৯৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা বাড়িতে অনেকটা অবসর সময় কাটাচ্ছে। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁও সদরে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থী রয়েছে ৬৫ হাজারের কাছাকাছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কোচিং সেন্টারও বন্ধ থাকায় এসব শিক্ষার্থীর পড়াশোনায় প্রভাব পড়েছে।
অভিভাবকরা বলছেন, এক বছর আগে শিশুরা ভোর থেকে পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়তো ও স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিত। এখন মিলছে ভিন্ন চিত্র। বিদ্যালয়ের কথা ভুলে গিয়ে এখন তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ছে প্রযুক্তি গেমসে। সাধারণত বাচ্চারা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় মগ্ন থাকতে ভালোবাসে। কিন্তু এ সময়ে তারা প্রযুক্তির গেমস বেঁচে নিয়েছে। অনেক অভিভাবকবৃন্দ অনিচ্ছাকৃত হাতে তুলে দিচ্ছেন এই প্রযুক্তির গেমস। ঘরে রাখার জন্যই তারা এ উপায় অবলম্বন করছেন। এতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে।
ঠাকুরগাঁও সদরের রুহিয়া এলাকার শিক্ষিকা রাবেয়া সুলতানা তার সন্তানের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আপলোড করে একটি পোস্ট দিয়েছেন। এতে তিনি লিখেছেন,‘করোনা মহামারীতে বাসায় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সন্তানকে সামলানো। ছেলে এমনিতেই প্রযুক্তি গেমসে আসক্ত। বাসার বাইরে যেতে বাধা দেয়ায় সে এখন এটাকে প্রধান কাজ হিসেবে বেছে নিয়েছে। কোনো কিছুতেই এটা থেকে তাকে সরানো যাচ্ছে না। বাধা দিলে উল্টাপাল্টা জবাব দেয় অথবা ভাইয়ের সাথে ঝগড়া শুরু করে দেয়। তাই নীরবে এখন সয়ে যাচ্ছি।’
রাবেয়া সুলতানা হাসির সাথে কথা বলে জানা যায়, দুই ছেলে সন্তানের মা তিনি। বড় ছেলে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী। স্বামী সাংবাদিক। হাসি শিক্ষকতা পেশা যথাযথভাবে পালনের পাশাপাশি পরিবারের রান্না-বান্না, হাতের কাজ ও শিক্ষক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। করোনা মহামারীতে অন্যদের মতো তার জীবনও এখন অনেকটা থমকে গেছে।
শাহিনা আক্তার একজন গৃহিনী। তার একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে। স্বামী মারা গেছেন। ফলে সন্তানের দায়িত্ব ও সংসারের সব কিছু তিনি একাই সামলান। তবে করোনায় তাকে একটু বেশি দায়িত্বের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তিনি বলেন,‘আগে সকাল হলেই বাচ্চা নিয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুল শেষে আবার বাসায় নিয়ে আসতাম। বাকি সময়টা বাচ্চা প্রাইভেট টিচার আর কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকত। আমি তখন শুধু মনিটরিং করলেই চলত। কিন্তু এখন করোনাভাইরাসের কারণে সব কিছু বন্ধ করে দেয়ায় বাচ্চার দায়িত্ব নিতে হয়েছে। বাচ্চা একেবারেই নাছোড়বান্দা। কোনো কথাই শুনতে চায় না। তার বর্ণনা অনুযায়ী, মেয়েটা এখন পড়াশোনার চেয়ে বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছে মোবাইল গেমসে। এতে বাধা দেয়া হলে তার হাজারটা প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে।
মেয়ের কথা হলো,‘আর কত দিন এভাবে বাসায় থাকব। আগে বিকেলে সাইকেল চালাতাম, এখন তাও দাও না। বাইরে গেলে মাস্ক পরতে হচ্ছে, হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা লাগছে। এভাবে আর ভালো লাগে না।’ তাই বাচ্চার স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে বাধ্য হয়ে প্রযুক্তি গেমস ব্যবহারের সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছি।
এ সমস্যা শুধু শাহিনা আর রাবেয়া সুলতানা হাসির নয়। একই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন প্রতিটি পরিবারের অভিভাবকবৃন্দ।
এ সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে রুহিয়া ক্যাথলিক মিশন ইনচার্জ ফাদার আন্তোনি সেনের সাথে কথা বললে তিনি জানান, ডিজিটাল গেমস শিশুদের ওপর মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক প্রভাব ফেলে। এ ক্ষেত্রে মায়েদের বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশুদের বেশি বেশি গল্প শোনাতে হবে। চিত্রকলা, গান, নাচ প্রভৃতির সাথে যুক্ত করতে হবে। পর্যাপ্ত সময় দেয়া ও তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হয়, এমন খেলাধুলায় ব্যস্ত রাখা গেলে প্রযুক্তি আসক্তি অনেকটাই কমানো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তিনি।