চট্টগ্রাম | শনিবার ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ
মুহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন | চট্টগ্রামের বার আউলিয়ার সরদার হযরত শাহপীর আউলিয়া (রহ:) এর ৭৪৬তম বার্ষিক ওরশ শরীফ গত বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি-২৩) লোহাগাড়া থানাধীন দরবেশহাট সংলগ্ন হযরত শাহপীর আউলিয়া (রহ:) এর মাজার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়েছে। উক্ত পবিত্র মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে আলোচনা করেন বায়তুশ শরফের সম্মানিত পীর সাহেব রাহবারে বায়তুশ শরফ আল্লামা শায়েখ মুহাম্মদ আবদুল হাই নদভী (মা.জি.আ.)। উক্তো মাহফিলে দেশ বরেণ্য ওলামায়ে কেরামগণ ও বুযুর্গানে দ্বীন তরশরীফ আনেন এবং মাওলানা মোহাম্মদ শিহাব উদ্দিনের সঞ্চালনায় সারারাত ব্যাপী বিশেষায়িত বক্তা দ্বারা গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজ নসিহত ছাড়াও তরীকতে কাদেরিয়ার যিকির আযকার শেষে ফজরের নামাজের পূর্বে আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে উক্ত পবিত্র মাহফিল সমাপ্ত হয়।
উল্লেখ্য যে, হযরত শাহপীর আউলিয়া (রহ.) এর বার্ষিক মাহফিলে অতীতে শিরক ও বিদ’আত পালন করা হতো। চলতো সারারাত ব্যাপী গাণ-বাজনা, তবলা, নারী পুরুষের অবাধে বিচরণ ও লালসালুদের আড্ডা খানা। বায়তুশ শরফের মহান রুপকার হাদিয়ে যামান শাহ সূফী হযরত মাওলানা শায়েখ মুহাম্মদ আব্দুল জব্বার (রহ:) যাবতীয় শিরক বিদ’আতের মুলোৎপাটন করে এখানে শরীয়ত মোতাবেক মাহফিলের আয়োজন করেন। পীর-আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রাম। শতশত বছর ধরে চট্টগ্রামবাসী এই অহংকারকেই লালন করে আসছে। বার আউলিয়ার অন্যতম ছিলেন বর্তমান লোহাগাড়া উপজেলার দরবেশহাট সংলগ্ন হযরত শাহপীর আউলিয়া (রহ.)।
ঐতিহাসিকদের মতে, ১৩৪০ খ্রীষ্টাব্দে সোনারগাঁও এর স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জয় করার অনেক পূর্বে ১২ জন সুফী, পীর আউলিয়াগণ আরব, বাগদাদ ও পারস্য হতে চট্টগ্রামে আসেন এবং ইসলাম প্রচার শুরু করেন। অষ্টম-নবম শতাব্দীতে চট্টগ্রামের সাথে আরব, পারস্য ও বাগদাদের বণিকদের যোগাযোগ ছিল এবং নবম শতাব্দী থেকে চট্টগ্রাম তথা দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুসলমানদের আগমন শুরু হয়। লোহাগাড়ায় হযরত শাহপীর (রহ:) এবং চকরিয়ায় হযরত শাহ ওমর (রহ:) দক্ষিণ চট্টগ্রামে প্রথম ইসলাম ধর্ম প্রচারক বলে ধারণা করা হয়।
হযরত শাহপীর আউলিয়া (রহ:) লোহাগাড়া থানাধীন দরবেশ হাট এলাকায় অবস্থান নিয়ে ইসলাম ধর্মের প্রচার শুরু করেন। অন্য তথ্য মতে, তিনি ইরাক হতে চট্টগ্রাম হয়ে লোহাগাড়ায় আসেন এবং দরবেশ হাটে অবস্থান নেন। ওই সময়ে দরবেশ হাট এলাকা বন-জঙ্গলে ভরপুর ছিল। সেখানে হিংস্র পশু ছিল। এই হিংস্র পশুরা হযরত শাহপীর (রহ:) কে শ্রদ্ধা করতো। জনশ্রুতি আছে তিনি হযরত শাহপীর (রহ:) হযরত শাহ ওমর (রহ:) এর ভাগ্নে। এলাকার প্রবীণদের মতে তাঁর পূর্ণ নাম শাহ মোহাম্মদ আবু ইউসুফ। তিনি হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ:) এর বংশধর ছিলেন। বায়তুশ শরফের প্রাণপুরুষ হযরত শাহ মাওলানা মীর মুহাম্মদ আখতরুল কাদেরী (রহ.) ১৯৬৫/৬৬ সালের দিকে হযরত শাহপীর আউলিয়ার মাজার যেয়ারত শেষে দীর্ঘক্ষণ মোরাকাবা শেষে বের হয়ে প্রিয় শাগরেদ আল্লামা শাহ মুহাম্মদ আবদুল জব্বার (রাহ.)-কে হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ:) এর রূহানী সন্তান হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। অনেক ঐতিহাসিক মতে, হযরত শাহপীর (রহ.) ছিলেন বার আউলিয়ার সর্দার ও ইরাকের একটি প্রদেশের বাদশা ছিলেন। তিনি ইয়েমেনের বাদশার পুত্র ছিলেন। আরেক মতে, তিনি বাদশাহী ও রাজকীয় পরিবেশ ত্যাগ করে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ইয়েমেন থেকে চট্টগ্রামে আসেন। বন-জঙ্গলে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। তাঁর বহু কারামতের কথা এখনো শুনা যায়।
জনশ্রুতি রয়েছে, বর্তমানে যেখানে মাজার রয়েছে সেই স্থানে হযরত শাহপীর (রহ:) শেষ বয়সে চিল্লায় পড়ে আল্লাহর ঝিকির ও ইবাদাত বন্দেগীতে মগ্ন থাকতেন। তিনি এ চিল্লা থেকে আর ইহজগতে ফিরে আসেননি। পরবর্তীতে বহু বছর পর তাঁর চিল্লাস্থানকে ভক্তরা মাজার পরিণত করেন। প্রতিদিন অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাঁর মাজার জেয়ারতে আসেন। তাঁর মাজারের উত্তর পাশের পুকুরে ছিল অসংখ্য গজাল মাছ। তাঁর তিনজন ব্যক্তিগত খাদেম ছিলেন। চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ সুফিয়া মাদরাসার উত্তরে ঐতিহ্যবাহী বহরমী পরিবারের দাবী- তারা উক্ত তিন খাদেমের উত্তরসুরী। হযরত শাহপীর আউলিয়া (রহ.) প্রথমে তাদের বাড়িতেই অবস্থান নিয়ে এলাকায় ধর্মপ্রচার করেছিলেন। এই বংশের লোকেরাই বংশ পরম্পরায় প্রায় সাড়ে সাতশত বৎসর হযরত শাহপীর (রহ.) এর মাজার ও মসজিদ পরিচালনা করে আসছেন। ওবায়দুর রহমান বহরমী দীর্ঘদিন মোতয়াল্লির দায়িত্ব পালন শেষে ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেন।
চট্টগ্রামের বার আউলিয়ার অন্যতম হযরত শাহপীর আউলিয়া (রহ.) এর মাজারকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন যাবৎ ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ, তরীকত সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ কিছু প্রভাবশালী লোকের পরিচালনায় ওরশের নামে মেলা বসিয়ে সংঘটিত করতো উচ্ছৃঙ্খল কর্মকান্ড। নারী পুরুষের অবাধ সমাগম, সেমার নামে অশালীন নাচগান, মদ, জুয়া, হাউজির আসর বসতো। ওরশকে কেন্দ্র করে কিছু স্বার্থান্বেষী লোক পকেট ভর্তি করতো। নিজ থানা এলাকায় ওরশের নামে বার আউলিয়ার অন্যতম হযরত শাহপীর (রহ.) এর মাজারে এরকম শরীয়ত বিরোধী অনৈসলামিক কর্মকান্ড বায়তুশ শরফের প্রধান রূপকার শাহসুফি শাহ আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ.)-কে প্রচন্ড পীড়া দেয়। হক্কানি পীর-মশায়েখরা শুধুমাত্র সাধারণ মানুষকে দ্বীনি তা'লিম দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেন না; বরং পবিত্র কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের সংগ্রাম আজীবন চালিয়ে যান। ইসলামের দুঃসাহসী সিপাহসালার বায়তুশ শরফের প্রধান রূপকার শাহসুফি আল্লামা মুহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ.) শরীয়ত বিরোধী কর্মকাণ্ডকে কখনো প্রশ্রয় দেননি। যেখানে সম্ভব হয়েছে তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন হেকমতের সাথে। বায়তুশ আনজুমনে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ পরিচালিত এই মাহফিল সুদীর্ঘ ৪৪ বৎসর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
হাদিয়ে যামান আল্লামা শাহ মুহাম্মদ আবদুল জব্বার (রাহ.) এবার উদ্যোগী হন, লোহাগাড়া দরবেশহাট হযরত শাহ্পীর (রহ.) এর মাযারে ওরশের নামে নাচ-গান, মদ, জুয়াসহ শরিআত বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধের। মরহুম হুজুর কেবলা মসজিদ ও মাজার পরিচালনা কমিটির মোতাওয়াল্লি যথাক্রমে মরহুম মাওলানা ছাদে আলম বহরমী, মরহুম মোস্তাফিজুর রহমান খান বহরমী, মরহুম ওবায়দুর রহমান বহরমী ভ্রাতাত্রয়কে ডেকে নিয়ে ওরশের নামে যতোসব অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডের কুফল তুলে ধরে কিভাবে শরীয়ত সম্মতভাবে মাহফিল পরিচালনা করা যায় তা নিয়ে আলাপ আলোচনা করেন। বহরমী পরিবারের মোতাওয়াল্লী কমিটির সদস্যরা সন্তুষ্টচিত্রে হুজুরের প্রস্তাবে সম্মতি দিলেও আর্থিক লোভ সামলাতে না পেরে স্থানীয় স্বার্থান্বেষী কিছু লোকের বিরোধিতা সত্বেও হুজুর কেবলার ইস্পাতদৃঢ় সিদ্ধান্ত, সর্বোপরি মোতাওয়াল্লী পরিবারের সহযোগিতায় ১৯৭৯ সালে যুগের মহান সংস্কারক আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ.) শতাধিক আলেম ওলামাসহ বিরাট এক কাফেলা নিয়ে হযরত শাহপীর (রহ.) এর মাজার প্রাঙ্গনে মাহফিলে ইছালে সাওয়াবের আয়োজন করেন। এরপর থেকে প্রতি বৎসর ২৩ ফেব্রুয়ারি বায়তুশ শরফের উদ্যোগে বার্ষিক মাহফিলে ইছালে সাওয়াবের আয়োজন হয়ে আসছে।
বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে আপডেট খবর পেতে ভিজিট করুন- talashtv24
সম্পাদক ও প্রকাশক: মুহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন
স্বত্ব © ২০২৪ তালাশটিভি২৪ www.talashtv24.com