চট্টগ্রাম | মঙ্গলবার, ১২ই এপ্রিল, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ
মুহাম্মদ হারুনুর রশিদ চৌধুরী (সাতকানিয়া): পরশপাথর বলা হয় এমন এক কাল্পনিক পাথর যার ছোঁয়ায় লোহা সোনায় পরিণত হয়। অনুরূপভাবে মাহে রমজানুল মোবারক মুসলিম বিশ্বের জন্য খোদা প্রদত্ত এক মহা পরশপাথর যার ছোঁয়ায় নিজকৃত গোনাহসমুহ থেকে পাক পবিত্র হয়ে আল্লাহ তা'য়ালার সান্নিধ্য অর্জন করা যায়। মাহে রমজানের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ রব্বুল আলামীন এই মাসে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করে এই মাসের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছেন। এ ব্যপারে তিনি নিজেই ঘোষণা করে বলেন। রমযানের মাসেই কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পুরোপুরি হিদায়াত। এমন দ্ব্যর্থহীন শিক্ষা সম্বলিত, যা সত্য-সঠিক পথ দেখায় এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়।
চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহের
আজকের সেহরী ও ইফতারের সময়ঃ
সেহরী- ০৪:১৮ মিনিট ও ইফতার- ০৬:১৫ মিনিট।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বড় বড় হৃদয় শিহরিত ঘটনা গুলো এই মাসেই সংঘটিত হয়েছে। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ, তাবুক যুদ্ধ ও মক্কা বিজয়সহ নানান ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল মাহে রমজানে।আত্মত্যাগের এই মাসে গোটা বছরের ক্ষতি পুরণ ও পুণ্যের পাহাড় জমাতে হবে সর্বাত্মক চেষ্টা ও সাধনার মধ্য দিয়ে। কেবলই উপবাস থাকার নাম রোজা রাখা নয়, সুবেহ-সাদিক থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার পাপাচার, কামাচার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ বিলাস থেকে বিরত থাকার নাম হচ্ছে সওম বা রোজা। এখন দেখা যায়, অনেকেই সেহরি খেয়ে রোজা রাখছে ঠিক অথচ নামাজের কোনো খবর নাই। সেই সাথে অন্যান্য দিনের মতো সকল প্রকার পাপাচার, মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার, গীবত সমালোচনা ইত্যাদি করেই যাচ্ছে। সংযত রাখতে পারেনি তার জিহ্বাকে গালমন্দ করা থেকে।
গালমন্দ সম্পর্কে রাসুল (সাঃ) বলেছেন, মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসেকি আর তাকে হত্যা করা কুফরি -(বোখারী ও মুসলিম শরীফ)।
গীবত সম্পর্কে আবূ বাক্রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, নবী করীম (সাঃ) দু’টি ক্ববর অতিক্রম করার সময় বলেন, নিশ্চয়ই এই দু’ক্ববরবাসীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে এবং তাদেরকে কোন কঠিন অপরাধের জন্য শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। এদের একজনকে পেশাবের (অসতর্কতার) কারণে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে এবং অপরজনকে গীবত করার কারণে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে -(সুনানে ইবনে মাজাহ)।
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত-
নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, অন্যায় কথাবার্তা, গীবত, মিথ্যা, গালিগালাজ, অপবাদ, অভিসম্পাত ইত্যাদি কাজ যে লোক (রোযা থাকা অবস্থায়) ছেড়ে না দেয়, সে লোকের পানাহার ত্যাগে আল্লাহ্ তা’আলার কোন প্রয়োজন নেই - (জামে' আত-তিরমিজি শরীফ)। কাজেই যদি রোজা রেখে তার ফল না পেলে উপবাসের কি প্রয়োজন, এজন্য সবসময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
মহিমান্বিত এই রমজান মাসে এসব কদাচিত বাদ দিয়ে নেকির কাজে নিমগ্ন হতে হবে। হতে হবে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে দৃঢ় প্রত্যয়ী। সাধ্যাতীত প্রচেষ্টা দিয়ে মুছন করতে হবে কৃত গোনাহের পাহাড়।
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত- রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াবের আশায় রমজান মাসের সিয়াম রাখলো, তার পূর্বের গুনাহগুলো মাফ করা হলো -(সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফ)। কাজেই শুধু পানাহার নয়, যাবতীয় অন্যায় অনাচার, জুলুম শোষন, নির্যাতন নিপীড়ন, গীবত পরনিন্দা, ক্রুদ অহমিকা ইত্যাদি পাপকার্য পরিহার করে রাত জেগে অশ্রুসিক্ত মোনাজাতের মাধ্যমে রমজান নামক পরশপাথরের ছোঁয়ায় নিজেকে সোনার মতো গোনাহ মুক্ত সচ্ছ করা অপরিহার্য। কিন্তু গায়ে গঞ্জে দেখা যায় কর্ম বিমুখীরা রোজা রেখে সময় কাঁটায় পরের সমালোচনা, বিভিন্ন খেলা, গান ইত্যাদি অহেতুক কাজে। এলাকার মহিলাদের বেশি দেখা যায় অন্যের দোষ তালাসে মশগুল। কিন্তু দিনগুলো তো এইসব মন্দ কাজের জন্য নয়, কুরআন তেলাওয়াত, নফল ইবাদাত তাসবিহ পাঠ ইত্যাদিতে আমলকে করতে হবে পরিপাটি ও গড়তে হবে পরিশুদ্ধ জীবন।
বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে দেশ-বিদেশের সব খবর সবার আগে জানতে ভিজিট করুন- talashtv24.com
দুনিয়াবি সকল ব্যস্ততা সাধ্যানুযায়ী পরিত্যাগ করে কেবলই প্রতিপালকের গোলামিতে একাকার হয়ে আখেরাতের সুদীর্ঘ পথের পাথেয় জোগাড় করার এখনই মোক্ষম সময়। ফজিলতপুর্ণ এই মাসে আল্লাহ তা'য়ালার কাছে বান্দার মান-মর্যাদা বৃদ্ধির উপকরণ রেখেছেন চমৎকার ভাবে। যেমন- রমজান মাসের সাধারণ নফল আমল এক এ ৭০ এর অধিক নেকি। তেমনিভাবে, সিয়ামের মহিমায় নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, মহান আল্লাহ্ ঘোষণা করেন যে, সওম আমার জন্য, আর আমিই এর প্রতিদান দেব। যেহেতু সে আমারই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তার প্রবৃত্তি, তার আহার ও পান ত্যাগ করেছে। আর সওম হল ঢাল। সওম পালনকারীর জন্য আছে দু’টি আনন্দ। এক আনন্দ হলো যখন সে ইফ্তার করে আর এক আনন্দ হলো, যখন সে তার রবের সঙ্গে মিলিত হবে। আল্লাহ্র কাছে সওম আাদায়কারীর মুখের গন্ধ মিস্কের সুগন্ধি হতেও উত্তম -(সহীহ বুখারী শরীফ)।
বুঝা গেল, সিয়াম পালনকারীর কদর রব্বুল আলামিনের নিকট অনেক গুণ বেশি! ইফতার সামনে নিয়ে বসে থাকলেও কল্যাণ, তার মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিস্ক হতেও সুগন্ধি।
অন্য হাদিসে আছে, হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক বলেন, প্রতিটি সৎ কাজের প্রতিদান হলো দশ গুণ হতে সাতশত গুণ পর্যন্ত। কিন্তু রোজা শুধুমাত্র আমার জন্য এবং এর প্রতিদান আমি নিজেই দিবো। রোজা জাহান্নাম হতে (বাঁচার) ঢাল স্বরুপ। আল্লাহ তা'য়ালার নিকট রোজা পালনকারীর মুখের গন্ধ কন্তুরী ও মিশক আম্বরের গন্ধের চেয়েও অধিক পছন্দনীয়। তোমাদের কোনো রোজা পালনকারীর সাথে যদি কোনো জাহিল মুর্খতা সুলভ আচরণ করে তবে সে যেন বলে আমি রোজাদার -(জামে' আত-তিরমিজি শরীফ)।
সুতরাং কেউ যদি অসৎ আচরন করে তবে তার বদলা না নিয়ে মুখে বলা যে আমি রোজাদার। উপবাস পানাহার সব কষ্ট সহে কেউ অসদাচরণ করলে তার উল্টো প্রতিবাদ না করে কেবলই আল্লাহর কাছে চাইলে তিনি এর চেয়ে উত্তম প্রতিদান দিবেন -ইনশাআল্লাহ।
রমজান নামক এত বিশাল খোদা প্রদত্ত অপার উপভোগ করতে না পারলে বড়োই কপাল পোড়া। হাদিস শরীফে এসেছে, তিন ব্যাক্তির উপর আল্লাহ তা'য়ালার লা'নত। তার মধ্যে যে ব্যাক্তি রমজান মাস পেয়ে নিজের পাপ মুছন করতে পারে নাই, জিবরাইল (আঃ) বলেন ফেরেস্তাদের লা'নত রাসুল (সাঃ) তার দৃঢ়তারার্থে বলেন আমিন। কাজেই সিয়াম ও কিয়ামের (দিনে রোজা ও রাতে তারাবীহ আর তাহাজ্জুদ) দ্বারাই মহাপরাক্রমশালী মালিকের ক্ষমা লাভ, তার সান্নিধ্য, পুণ্যের ভার, পরকালের পাথেয় ইত্যাদি অর্জন করে আত্মশুদ্ধির অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ সময়কে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া ঈমানের দাবি। জীবন শুদ্ধতায় রমজান। বেহেশতি শওগাত এই রমজান। অবহেলা, অলসতা প্রতিপন্ন করে রহমতের দিনে দয়া করুণা, মাগফিরাতের দিনে গোনাহের ক্ষমা আর নাজাতের দিনে জাহান্নাম হইতে মুক্তি লাভের প্রত্যাশায় অতি উৎসাহীর সহিত সাধনায় সচেষ্ট হয়। বিশেষ করে শেষ দশ দিনের বেজোড় দিনগুলোর মধ্যে এমন একটি রাত আছে যে রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। সুতরাং তার আশায় এখন থেকে পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া দরকার। অতএব সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সমীপে আকুল আবেদন, সম্মানিত মাহে রমজানের বিশেষায়নে বিশেষায়িত হতে ওতপ্রোতভাবে নিজেকে জড়িয়ে রাখি এবং মাহে রমজানের শান-মান ক্ষুন্ন হয় এমন আচরণ পরিহার করি। আল্লাহ পাক সবাইকে আমল করার পুর্ণ তৌফিক দান করুন -আমিন।
লেখক:- মুহাম্মদ ইউনুস আহমেদ
দাওরায়ে হাদিস কমপ্লিট,
জামিয়া জিরি মাদরাসা, চট্টগ্রাম।
সম্পাদক ও প্রকাশক: মুহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন
স্বত্ব © ২০২৪ তালাশটিভি২৪ www.talashtv24.com