প্রধানমন্ত্রীর চোখে অশ্রু, শিলা গুহর করুণ কাহিনী!
প্রকাশিত: রবিবার, ২০শে জুন ২০২১ খ্রিস্টাব্দ
নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ২য় পর্যায়ে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জমি ও গৃহ দান কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে সবার কাড়েন বীরাঙ্গনা শিলা গুহ। শিলা গুহর কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রীর কান্না গোটা অনুষ্ঠানকে আবেগমন্ডিত করে রাখে। রবিবার (২০শে জুন) সকালে ওই অনুষ্ঠানে শিলা গুহ বলেন, ‘যুদ্ধের সময়ও তিনি বোঝেননি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেষ বয়সে শিলা গুহদের দেখে রাখবেন। কালকে ছিলাম পথের ভিখারি, আজকে হলাম (ঘর পেয়ে) লাখপতি। স্বর্গ থেকে বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গমাতা আজ এ খুশির মুহূর্তটি দেখছেন এবং তাদের আত্মা শান্তিতে ভরে উঠছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যেন করোনাভাইরাস কিংবা কোনো বিপদ আক্রান্ত করতে না পারে, এ জন্য তিনি প্রতিদিন দু’টাকার মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করে আসছেন।
এ সময় বীরাঙ্গনা শিলা গুহ তার বক্তব্যের শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শ্রীমঙ্গলে তার দেওয়া ঘর দেখতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান এবং বলেন প্রধানমন্ত্রী সেখানে গেলে তিনি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সাতকরা দিয়ে তাকে তরকারি রান্না করে খাওয়াবেন।' এ সময়ে শ্রীমঙ্গলসহ সব অনুষ্ঠানস্থল তুমুল করতালিতে মুখরিত হয়ে পড়ে। জানা যায়, যাত্রাশিল্পী শিলা গুহ’র বাড়ি ছিল বাগেরহাট। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন কুড়িগ্রামের একটি যাত্রা দলে। কুড়িগ্রামের অলিপুর বালিকা বিদ্যালয়ে থাকাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নির্যাতিত হন শিলা। তখন তার নাম ছিল শিলা সাহা। পরে পিরোজপুরের যতীন গুহকে বিয়ে করে শিলা গুহ নাম ধারণ করেন।
পাকিস্তানিরা মৃত ভেবে তাকে ফেলে রাখে। ফলে বেঁচে যান। নির্যাতনের কথা জানতে পেরে দুই মেয়েসহ শিলা গুহকে ফেলে যান স্বামী যতিন। জায়গা হয়নি বাগেরহাটে বাবার বাড়িতে। আবারও যোগ দেন যাত্রা দলে। বিয়ে দেন দুই মেয়েকে। এরই মধ্যে বয়স বাড়তে থাকে কমতে থাকে কাজ। দুই মেয়ের এক মেয়ে স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে ফিরে আসে মায়ের কাছে। মেয়েকে নিয়ে শেষ দিনগুলিতে মানুষের ঘরে ঘরে কাজ করে সংসার চালাচ্ছিলেন শিলা গুহ। শিলা গুহ নিজেই জানান তার জীবনের করুণ কাহিনি। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে যাত্রাদলের সঙ্গে কুড়িগ্রামে ছিলাম। দলের সঙ্গে অলিপুর স্কুলের একটি কক্ষে থাকার ব্যবস্থা হয়। পাশেই নাট মন্দির।
সেখানে যাত্রাপালা হওয়ার কথা ছিল। এই সময় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তখন দেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা আওয়ামী লীগ নেতা, ও কমবয়সী গৃহবধূদের খান সেনাদের হাতে তুলে দিত। তিনি জানান, একদিন সন্ধ্যায় রাজাকাররা একটি জিপে করে পাক সেনা নিয়ে হাজির হয় অলিপুর গার্লস স্কুলে। যাত্রাদলের পুরুষরা তখন বাইরে ছিল। শিলা তখন স্কুলের বারান্দায় বসে ছিলেন। অস্ত্রের মুখে শিলা, সবিতা ও মিনু নামে যাত্রাদলের তিন তরুণীকে ধরে নিয়ে যায় স্থানীয় ডাক বাংলোয় সেনাবহিনীর ক্যাম্পে। এখানে আরো কয়েকজনের সঙ্গে শিলা নির্যাতনের শিকার হন। একাধিক সেনাসদস্যের ধর্ষণের শিকার হন তিনি। দিনের পর দিন শিলা ও অন্য তরুণীদের আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে পাকিস্তানি সেনারা। কখনো কখনো অজ্ঞান হয়ে যেতেন তিনি। ওই অবস্থায় কখনো সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে, কখনো বা গরম চায়ের কাপে আঙুল ডুবিয়ে জ্ঞান ফেরাত সেনাসদস্যরা।
শিলা জানান, এভাবে কিছুদিন চলার পর একদিন জ্ঞান না ফিরলে তারা শিলাকে মৃত ভেবে পাশে একটি ধান ক্ষেতে ফেলে দেয়। পরদিন সকালে সেখান থেকে স্থানীয় আবুল হোসেন ও তার ভাই সাত্তার লাশ দেখতে গিয়ে দেখেন শিলার শ্বাস রয়েছে। তখন তারা শিলাকে তাদের বাড়ির পাশে একটি হিন্দু বাড়িতে রেখে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করেন। তাদের দেখাশোনার জন্য জানানো হয় তাদের দলের মিনু ও তার স্বামী সুবাসকে। এ খবর খান সেনাদের কাছে গেলে তারা শিলাকে ক্যাম্পে পাঠাতে বলে। কিন্তু আবুল হোসেন ও সাত্তার তাকে রাখার বিষয়টি অস্বীকার করেন এবং আবুল পরে মধু নামে এক লোককে দিয়ে তাকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেন। এরপর মধু পরিবারের লোকজনসহ শিলাকে ভারত চলে যান।
শিলা জানান, দেশ স্বাধীনের পর দেশে ফিরে শিলা বাগেরহাটের পেয়াজহাটির কচুর হাটখোলায় নিজের বাড়িতে আসেন। বাবা বিহারী লাল সাহা ইতিমধ্যেই মেয়েকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যাওয়ার সংবাদ পান দলের লোকজনের কাছে। পরিবারের অন্য ছেলে-মেয়েদের কথা চিন্তা করে বাবা তাকে বাড়িতে জায়গা দেননি। শিলা বলেন, কয়েক বছর পর যাত্রাদলের গাড়িচালক যতীন গুহের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। শিলা সাহা থেকে তার পদবি হয় শিলা গুহ। তাদের সংসারে দুটি মেয়ে হয়। কিন্তু ছয় বছর পর স্বামী যতীন গুহ শিলার নির্যাতনের বিষয় জানতে পারেন। এরপর স্বামী যতীন পিরোজপুরে মাকে দেখতে যাওয়ার কথা বলে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। স্বামীকে বিভিন্ন স্থানে খুঁজে না পেয়ে শেষে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল এসে আশ্রয় নেন শিলা। সেখানে গৃহস্থালিও কাজ করে জীবন কাটাতেন।
শিলা আরো জানান, ভারত থেকে ফিরে তিনি মিনারভা, নিউ মিনারভা, বনশ্রী, গীতাশ্রী, রংমহল, বঙ্গশ্রী, মুনলাইট, আর্জ অপেরা ও সাধনাসহ অনেক যাত্রাদলে কাজ করেছেন। আবার যাত্রার দুর্দিনে মানুষের বাসায় কাজ করে দুই মেয়েকে বড় করেন। কষ্ট করে বিয়েও দেন। বিয়ের পর বড় মেয়ে স্বামীর বাড়িতে সংসার করলেও ছোট মেয়ে এক সন্তান নিয়ে ফিরে আসেন তার কাছে। শিলা গুহ বিষয়ে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, তার কথা প্রথমে জানতে পারি শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বিকুল চক্রবর্তীর মাধ্যমে। সেই থেকে তার জন্য কিছু করার তাগিদ ছিল। অন্তত প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া একটি ঘর তার জন্য আমরা বরাদ্দ করতে পেরেছি এটা আনন্দের। সেই সঙ্গে আমরা গর্বিতও।
এ বিষয়ে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান জানান, বীরাঙ্গনা শিলা গুহের কান্না ও কথা শুনে প্রধানমন্ত্রীর চোখে জল এসেছে। সেই সঙ্গে সারা দেশের মানুষের চোখ ভিজেছে। তবে শিলা গুহের আজকের কান্না ছিল আনন্দ অশ্রু। দেশের জন্য শিলা গুহ যে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, সেই ক্ষত পূরণ হওয়ার নয়। তবে আমরা প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের কারণে তার মাথা রাখার জন্য একটি ঘর দিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছি। শিলা গুহর পাশে আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং জেলা প্রশাসন আজীবন পাশে থাকবে। যখনই তার কোনো প্রয়োজন আমরা জানতে পারব পাশে দাঁড়াব।
সম্পাদক ও প্রকাশক: মুহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন
স্বত্ব © ২০২৪ তালাশটিভি২৪ www.talashtv24.com