নিজস্ব ডেস্ক :
নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর পরে দ্বিতীয় সপ্তাহও শেষ হচ্ছে। প্রতি বছর একই সময় ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রমও। কিন্তু এবারের চিত্র উলটা। সন্তানদের নতুন শ্রেণিতে ভর্তি করাতে আগ্রহ নেই অভিভাবকদের।
একদিকে গত বছরের মার্চ থেকে বকেয়া টিউশন ফি, অন্যদিকে নতুন শ্রেণিতে ভর্তি। বড় অঙ্কের আর্থিক চাপ ভর করেছে অভিভাবকদের ওপর। এছাড়া স্কুল খোলা নিয়ে অনিশ্চয়তায়ও ভর্তিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না অভিভাবকরা। আর সেমিস্টার ফির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই শিক্ষার্থীর। কিন্ডারগার্টেনের চিত্র আরও ভয়াবহ।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের জন্য আরও তিন মাসের অ্যাসাইনমেন্ট প্রস্তুত করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ২০২১ শিক্ষাবর্ষের আলোকে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের এই অ্যাসাইনমেন্ট করতে হবে। একই সঙ্গে নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে ফের চালু হবে সংসদ টিভি ও অনলাইন ক্লাস। নতুন শিক্ষাবর্ষে এই অ্যাসাইনমেন্টের পাশাপাশি স্কুল খোলার আগ পর্যন্ত টেলিভিশন ও অনলাইনে ক্লাসও চলবে। নতুন শ্রেণিতে ভর্তি না হলে নতুন খাতায় নাম উঠবে না। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে স্কুল থেকে। ফলে যেসব শিক্ষার্থীর স্কুলের সঙ্গে সংযোগ থাকবে না তারা বিপাকে পড়বে। অ্যাসাইনমেন্টে অংশ নিতে পারবে না। ফলে পিছিয়ে পড়বে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, যেসব স্কুলে বছরের শুরুতে ভর্তির জন্য নানামুখী তদবির হয়, এবার সেসব স্কুলের অবস্থাও ভালো নয়। পুরনো শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের মোবাইলে ফোন করে ভর্তির জন্য অনুরোধ জানালেও তাতে তেমন একটা সাড়া মিলছে না।
এক শিক্ষক তার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর এক অভিভাবককে ভর্তির বিষয় অবহিত করলে ঐ অভিভাবক শিক্ষককে জানান, ‘সন্তানকে কীভাবে ভর্তি করাব। ওর বাবার চাকরি নেই। বকেয়া টিউশন ফি ও নতুন ভর্তি ফি দেওয়া সম্ভব নয়।’ এমন অসহায়ত্বের কথা অভিভাবকরা শিক্ষকদের কাছে জানাচ্ছেন, বকেয়া টিউশন ফি মওকুফ চাইছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে অনেক অভিভাবক চাকরি হারিয়েছেন। পুঁজি হারিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী অভিভাবক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি থাকলেও অনেকের বেতন কমেছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছে গ্রামে ফিরে গেছেন। ফলে অভিভাবকরা আর্থিক কষ্টে আছেন। এ কারণে স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করাতে পারছেন না।
আমিরুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলেন, করোনাকালীন টিউশন ফি কমানোর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণায়ের কাছে অভিভাবকেরা যে আবেদন করেছিলেন, তা আমলে নেওয়া হয়নি। এ কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুলে ভর্তি হতে পারছে না। করোনায় অভিভাবকদের ক্ষতি হয়, ক্ষতির ভাগ সবাইকে নিতে হবে। এমনকি শিক্ষকদেরও। গত বছরের ৯ মাসের টিউশন ফি মওকুফ বা অর্ধেক করে দিলেও অভিভাবকরা তার সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী হতেন। কত সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে তার হিসাব কষতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি অনুরোধ জানান এই অভিভাবক।
রাজধানীর মিরপুরের একটি হাইস্কুলের ২ হাজার শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র ৭০০ শিক্ষার্থী স্কুলে ভর্তি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি জানান, করোনার কারণে অভিভাবকরা ৯ মাস টিউশন ফি দিতে পারেনি। এছাড়া নতুন শ্রেণিতেও ভর্তি হতে টাকা লাগবে। এ কারণে অভিভাবকরা ভর্তি হতে আসছে না। কোনও কোনও অভিভাবক গত বছরের পুরো টিউশন ফি মওকুফের দাবি জানাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষকদের বেতন-ভাতার বিষয়টি বিবেচনায় এনে এটা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি জানান, হাতে গোনা কিছু নামি প্রতিষ্ঠান ছাড়া সারা দেশের চিত্র এটি। ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা করেন এই শিক্ষক নেতা।
মিরপুরে অবস্থিত মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়েরও চিত্র একই। প্রতিষ্ঠানটির একজন শিক্ষক জানিয়েছেন, অর্ধেক শিক্ষার্থীও এখনো ভর্তি হয়নি। বাছির উদ্দিন নামে শিক্ষক সমিতির সাবেক এক নেতা বলেন, শিক্ষার সমস্যা কোথায়, কেন? এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে সরকারকে সিদ্ধান্ত ও কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।
আর কিন্ডারগার্টেনের চিত্র আরও ভয়াবহ। রাজধানীর একটি কিন্ডারগার্টেনের উদ্যোক্তা সুলতান হোসেন জানান, গত বছর ৫০০ শিক্ষার্থী ছিল। গত বছরের ৯ মাসের টিউশন ফি কেউ দেয়নি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাত্র ১০ জন শিক্ষার্থীকে পেয়েছেন, যারা ভর্তিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু ১০ জন শিক্ষার্থী দিয়ে চলবে না। যদিও আগেই শিক্ষকরা বেতন-ভাতা না পেয়ে চলে গেছেন। প্রতিষ্ঠানটি স্থায়ীভাবে বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—জানালেন এই কিন্ডারগার্টেনের মালিক।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানে প্লে-শ্রেণিতে গতবার ১০০ শিক্ষার্থী পেয়েছি। এবার পেয়েছি মাত্র ৩ জন। আর পুরনো শিক্ষার্থীর এক-চতুর্থাংশও আসছে না।’ তিনি জানান, দেশের প্রায় কিন্ডারগার্টেন স্কুলের অবস্থা শোচনীয়। বকেয়া টাকা দেওয়ার ভয়ে আসছে না কেউ। আর স্কুল না খোলার কারণেও স্কুলে আসতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না কেউ। স্কুল খুলে দিলে আগের মতো না হলেও শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশ স্কুলে ফিরবে বলে মনে করেন এই উদ্যোক্তা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অপেক্ষা করছে এইচএসসির ফলের জন্য। তাদের আশা, এবার যেহেতু সবাই পাশ করবে এ কারণে এ ফল প্রকাশের পর বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ তৈরি হবে। পুরনো শিক্ষার্থী ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়।
রাজধানীর সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রকৌশলী আব্দুল আজিজ বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি বড় অংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে। ইতিমধ্যে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা প্রাইভেট টিউশনি করে যে টাকা আয় করত সেখান থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় খরচ বহন করত। কিন্তু করোনায় এসব প্রাইভেট টিউশনি বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া যেসব শিক্ষার্থী পার্টটাইম চাকরি করত সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। এই দুই শ্রেণির শিক্ষার্থী গ্রামে ফিরে গেছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করছে না। এসব শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে বলে মনে করেন এই উদ্যোক্তা।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, টিউশন ফির বাইরে অন্য কোনও ফি না নেওয়ার জন্য মাউশির পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা তো টিউশন ফি কমানোর নির্দেশ দিতে পারি না। তিনি বলেন, স্কুলে অ্যাসাইনমেন্ট কার্যক্রম চলবে। আমরা তো শিক্ষার্থীদের জোর করে স্কুলে আনতে পারি না। অপেক্ষা করতে পারি।